Google Ads

❝জন্মালেই মানুষ হয় না❞ - একটি অনুপ্রেরণার গল্প পর্ব -০১। কৃষিসেবা-২৪

❝জন্মালেই মানুষ হয় না❞ - একটি অনুপ্রেরণার গল্প পর্ব -০১।  কৃষিসেবা-২৪

অনুপ্রেরণার গল্প
পলান সরকার


'জন্মালেই মানুষ হয় না। শিক্ষাই মানুষকে মানুষ করে। আমি নিজে কিন্তু কিছু না। পাঁচ মাস বয়সে বাবা মারা গিয়েছেন। কলেজ-ভার্সিটি পড়তে পারিনি। নিজে নিজে লেখাপড়া করেছি। এক মাস্টার বিনা পয়সায় প্রাইমারি পড়িয়েছিলেন, তাও সেই স্কুলে ক্লাস ফাইভ ছিল না। চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিলাম। তাও ফাইনাল পরীক্ষা দিতে পারিনি। পরীক্ষা দেওয়ার জন্য নাটোর যাওয়ার কথা ছিল, সেই নাটোরে যাওয়ার পয়সা দেওয়ার কেউ ছিল না। তাই যাওয়া হয়নি, পরীক্ষাও দেওয়া হয়নি। আমার পড়াশোনা ওইটুকুই। দুনিয়া আমার এভাবেই চলছে। আজ যতটুকু আসতে পেরেছি, নিজের চেষ্টাতেই পেরেছি।'

     - পলান সরকার

গ্রামের লোকেরা সকালে ঘুম ভেঙে দেখতে পেতেন, তাদের আঙিনায় হাস্যোজ্জ্বল মুখে দাঁড়িয়ে আছেন পলান সরকার। তাঁর কাঁধে ঝোলা, ঝোলার ভেতরে বই। বয়সে প্রায় শতবর্ষী, কিন্তু ত্রিশ বছরের যুবকের মতো শেষ দিন পর্যন্ত সমান সচল। কাঁধে ঝোলা নিয়ে প্রতিদিন মাইলের পর মাইল হেঁটে গ্রাম-গ্রামান্তরে যেতেন। নিজের টাকায় কেনা বই বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষকে পড়তে দেন। পড়া শেষ হলে দিয়ে আসেন নতুন কোনো বই। এভাবে একটানা প্রায় চল্লিশ বছর ধরে করেছেন এই কাজ। 

পলান সরকার, এক অশীতিপর বৃদ্ধ; কাঁধে একটি ঝোলা আর ঝোলাভর্তি বই, চোখে মোটা কাঁচের ঘোলাটে চশমা, গায়ে সাদামাটা পাঞ্জাবী। হাঁটছেন গাঁয়ের কোনো মেঠো রাস্তা ধরে। পাশের ধানক্ষেত থেকে কেউ বলে উঠলো “ বইওয়ালা দুলাভাই, কই যান?”। মিষ্টি হেসে জবাব দিলেন দুলাভাই। গ্রামের সকলের কাছে তিনি বইওয়ালা দুলাভাই নামে পরিচিত।

বাউসা গ্রামের খুব ভোরে যারা মাঠে যেত, তারা সবার আগে পলান সরকারকেই দেখতে পেত। গ্রামের লোকজন খুব ভোরেই তার কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পায়। আর দরজা খুললেই দেখা যেত হাসি মুখে পলান সরকার দাঁড়িয়ে। প্রতিদিন খুব ভোরে উঠেই বইয়ের ঝোলা কাঁধে পলান বেরিয়ে যেতেন। মাইলের পর মাইল হেঁটে দূর দুরান্তের গ্রামে যেতেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে কড়া নেড়ে বই দিতেন এবং তা আবার সপ্তাহখানেক বাদে ফেরত নিতেন। এভাবে রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার প্রায় ২০টি গ্রামে হাজারো মানুষকে তিনি যে আলোয় আলোকিত করেছেন তার নজির এ দেশে খুব কম। বই দেয়া এবং নেয়ার মাধ্যমে তিনি যে শিক্ষা আন্দোলন গড়ে তুলেছেন তা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’র মাধ্যমে দেশবাসীর নজরে আসে।

১৯২১ সালে নাটোর জেলার বাগাতি পাড়া গ্রামে পলান সরকারের জন্ম। হায়াত উল্লাহ সরকার এবং মইফুন্নেসার ৩ পুত্র এবং ২ কন্যার মৃত্যুর পর তার জন্ম হয় বলে মা তাকে পলান বলে ডাকতেন। প্রকৃত নাম হারেজ উদ্দিন সরকার। মাত্র ৫ মাস বয়সে পিতার মৃত্যু হলে নানা ময়েন উদ্দিন নিজ কন্যা ও নাতিকে নিজ গ্রাম বাউসাতে নিয়ে আসেন। নানা ময়েন উদ্দিনের কোনো পুত্র সন্তান না থাকায় পলান বেশ আদরেই বেড়ে উঠছিলেন নানার সংসারে। সেখানে তিনি একটি স্কুলে ভর্তি হন যেখানে ষষ্ঠ শ্রেণীর পর লেখাপড়ার সুযোগ ছিল না। এইটুকু বয়সেই তার বই পড়ার অভ্যাস গড়ে উঠে। সেই অভ্যাসের বশেই তিনি যেখানে যে বই পেতেন, সংগ্রহ করতেন, নিজে পড়তেন এবং অন্যকেও বই পড়তে উৎসাহিত করেন।

নানা ময়েন উদ্দিন ছিলেন স্থানীয় ছোটখাট জমিদার। যৌবনে নানার জমিদারির খাজনা আদায় করতেন এবং পরবর্তীতে বাউসা ইউনিয়নে কর আদায়কারীর চাকুরি পান। বেতনের টাকা দিয়ে নিজে বই কিনতেন এবং মানুষকেও ধার দিতেন। নানার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারসূত্রে তিনি ৪০ বিঘা সম্পত্তির মালিক হন। সে সম্পত্তিও তিনি মানবকল্যাণে উৎসর্গ করেন।

যৌবনে তিনি যাত্রাদলে ভাঁড়ের ভূমিকায় অভিনয় করতেন। মানুষকে হাসি আনন্দ আর বিনোদন দিতে পছন্দ করতেন বলেই ভাঁড়ের ভুমিকায় অভিনয় করতেন। সেকালে যাত্রাপালার দলে লেখাপড়া জানা মানুষের বেশ অভাব ছিল। যাত্রাদলে একমাত্র লেখাপড়া জানা মানুষ ছিলেন পলান সরকার। সেই সময় যাত্রার স্ক্রিপ্ট কপি করার মতো ফটোকপি মেশিন ছিল না। ফলে পলানকেই যাত্রার স্ক্রিপ্ট লিখে লিখে কপি করতে হত। মাঝে মাঝে তিনি প্রম্পটের কাজও করতেন। প্রম্পট হলো যিনি মঞ্চের পেছন থেকে অভিনেতা অভিনেত্রীদের সংলাপ বলে দেন। এভাবে লেখাপড়ার সাথে তার সম্পৃক্ততা থেকেই যায়, যা পলানকে বই পাঠের অভ্যাস বজায় রাখতে সাহায্য করে।

১৯৯২ সালে তার ডায়াবেটিকস ধরা পড়লে ডাক্তার তাকে নিয়মিত ৩-৪ কিলোমিটার হাঁটার পরামর্শ দিলেন। এই হাঁটাকে তিনি ভিন্নভাবে কাজে লাগালেন। শুধু স্কুল ভিত্তিক বই বিতরণ না করে বাড়ি বাড়ি বই বিতরণের কথা ভাবলেন। যেই ভাবা সেই কাজ। এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, “আমি ভেবে দেখলাম, যারা আমার বাড়ি থেকে বই নিয়ে যায়, আমি নিজেই তো হেঁটে হেঁটে তাদের বাড়িতে গিয়ে বই পৌঁছে দিয়ে আসতে পারি। সেই থেকে শুরু। এক বাড়িতে বই দিতে গেলে তার দেখাদেখি আরেক বাড়ির লোকেরাও বই চায়। বই নিয়ে হাঁটা আস্তে আস্তে আমার নেশায় পরিণত হলো।”

পলান সরকার হাঁটতে শুরু করলেন গ্রামে গ্রামে, বই পৌছে দিতে থাকলেন মানুষের ঘরে ঘরে। গ্রামের সাধারণ গৃহিণী থেকে শুরু করে স্কুলগামী ছাত্রছাত্রীদের নিকট হয়ে উঠলেন বইওয়ালা দুলাভাই। কোনো বাড়িতে গেলে তাকে খুব আপনজনের মত সমাদর করা হত। গ্রামের পথে ঘুরতে ঘুরতে নিজেই হয়ে উঠলেন এক ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার। তার এই বই পড়ার আন্দোলন উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের সেই সুবিধাবঞ্চিত গ্রামগুলোতে এক সুদূরপ্রসারী ভূমিকা ফেলে। আবদুর রহিম নামক এক মুদি দোকানদার তার নিয়মিত পাঠক। ৫৫ বছর বয়সী এই মুদি দোকানদার প্রচুর বই পড়তেন, আবার প্রতিদিন বিকেলে পাঠক সমাবেশ করতেন। পলান সরকারের এই উদ্যোগ এক মাদকাসক্তকেও দিয়েছিল নতুন জীবন।

তিনি বলতেন 'আমি সব জায়গায় বলি, ‘পড়লে বই আলোকিত হই, না পড়লে বই অন্ধকারে রই।’ অথচ এই আমি কিন্তু ঠিকমতো তেমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পাইনি। পড়েছি চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত। পরীক্ষার ফির সামান্য কয়টা টাকাও তখন দিতে পারিনি। এ জন্য আমাকে বিদ্যালয় ছাড়তে হয়েছিল। আমি বিদ্যালয় ছেড়েছি, কিন্তু কখনো বই ছাড়িনি। অশিক্ষার অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসার একটা প্রবল আগ্রহ তখন থেকেই আমাকে তাড়া করত।

 পলান সরকার একজন প্রচন্ড জীবনবাদী এবং সুরসিক মানুষ। আর দশটা মানুষের মত তিনিও বিয়ে করেছেন এবং ৯ সন্তান সন্ততিকে মানুষের মতো মানুষ করে তুলেছেন। নিজে পড়াশুনার সুযোগ পান নি বলে ছেলে মেয়েদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। বড় ছেলে মোজাফফর হোসেন বাউসা কলেজের প্রভাষক। ছোট ছেলেদের মধ্যে একজন একই কলেজের MLSS, আরেকজন বাউসা উচ্চ বিধ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক, আরেকজন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক, একজন মোবাইল ফোন কোম্পানির প্রকৌশলী এবং অপরজন ধানকলের ব্যবসায়ী। ৩ মেয়ের মধ্যে ছোটজন এম.এ পাস করেছেন বাকি দুইজন স্কুলের শিক্ষিকা।

সকাল বিকাল ২ বার হাঁটতে বের হতেন পলান সরকার।  ৯৪ বছর বয়সেও তিনি ২-৩ গ্রাম যেতেন প্রতিদিন। এভাবে বই বিতরণ করে জ্ঞানের প্রদীপ জ্বালিয়ে চলছেন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। বয়স পারে নি তাকে থামাতে।

পলান সরকার খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারতেন। কথা বলে মানুষকে হাসাতে পারতেন। কাঁদাতেও পারতেন। তাঁর বই পড়ার আন্দোলন সম্পর্কে ২০১৬ সালের নভেম্বরে প্রথম আলোর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে পলান সরকার বলেছিলেন, ‘আমি হাঁটতে হাঁটতে এই সমাজটাকে বদলানোর আন্দোলনে নেমেছি। যত দিন আমি হাঁটতে পারি, তত দিন আমার আন্দোলন চলবেই। আমি হাঁটতে হাঁটতে মানুষের বাড়িতে বই পৌঁছে দেবই। যাঁরা পাঠাগারে আসবেন, তাঁরা ইচ্ছেমতো বই পড়বেন। তবে আমার বয়স হয়েছে। জানি না আর কত দিন হাঁটতে পারব। যেদিন আমার পথচলা থেমে যাবে, সেদিন এই পাঠাগার আমার পক্ষে আন্দোলন করে যাবে। ’

কেউ কেউ আলোর পথেই চলে। সময় সমাজ কখোনো কখোনো বাঁধা দেয়, কিন্তুতাদের থামানো যায় না। থামানো যায়নি পলান সরকারকে।
পলান সরকারদের থামানো যায় না। আলো থামতে জানে না।

রাজশাহীর পলান সরকার।
রোজ ২০ -২৫ কিলোমিটার হেঁটে  বিনামূল্যে সবাইকে বই বিলি করেন। পড়া হলে আবার ফেরত নিয়ে নেন। ৩৫ বছর ধরে অজ-পাড়াগাঁয়ে  এভাবে তিনি নিরবে জ্ঞানের আলো জ্বালিয়ে চলছেন। 
তাই পলান সরকার নামটি শুনলেই মাথা নত হয়ে আসে। তিনি একাই একটি গণগ্রন্থাগার। 

No comments

Theme images by konradlew. Powered by Blogger.
close